ঝুঁকিপূর্ণ কাজে প্রায় ১৩ লাখ শিশু নিয়োজিত

শিশুশ্রম মুক্ত হয়নি বাংলাদেশ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মতো বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে অল্প মজুরি দিয়ে অধিক কর্মঘণ্টায় নিয়োজিত রাখা যায় বলে শিশুদের কাজে নিয়োগ দিতে মালিকপক্ষের আগ্রহ বেশি থাকে। অনেক সময় কোনো মজুরি ছাড়াই পেটে-ভাতে কিংবা সামান্য মজুরিতে শিশুদের কাজে রাখা হয়। পরিবারের অভাব-অনটন কিছুটা লাঘব করতে শিশুরাও আনন্দময় শৈশব ছেড়ে চলে আসে কর্মজীবনের কঠিন বাস্তবতায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। প্রতি বছর বাংলাদেশসহ বিশে^র ৮০টি দেশে এ দিবস পালিত হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘প্রজন্মের জন্য নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য’। এ উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আইএলও, সেভ দ্য চিলড্রেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন-এর সহযোগিতায় শিশুশ্রম প্রতিরোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক আলোচনা সভা, সারাদেশে পোস্টারিং এবং লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে লাখ লাখ শিশু কল-কারখানা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ঘর-বাড়িতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। আবার কেউবা কাজ করছে পরিবহণ শ্রমিক হিসেবে। বিশেষ করে টেম্পোর সহকারী হিসেবে ছোট শিশুরাই বেশি কাজ করছে। কথা হয় গুলিস্তান টু হাজারিবাগ রুটের টেম্পো হেলপার বরকতের সঙ্গে। তুমি কি স্কুলে যাওÑ শিশু বরকতের কাছে একথা জিজ্ঞেস করতেই জানাল ‘আগে যাইতাম এখন যাই না। বাবা অসুস্থ। মা আমারে এই কাজে দিছে। প্রতিদিন ৫০ টাকা পাই। আবার খাওয়ায়ও। সংসার চলবে কী করে গাড়িতে না আইলে।’ রবিউল বয়স ১২। সাত বছর বয়স থেকেই কাজ করছে চিমনি কারখানায়। ভোর থেকে আগুনের কু-লীতে কাজ শুরু হয়, সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। বিনিময়ে মাসে মাত্র ৭০০ টাকা পায়। এক সময় রাজু স্কুলে যেত কিন্তু এখন সে পেটের দায়ে কাজ নেয়। অমানুষিক পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠে, সপ্তাহে কোনো ছুটিও নেই। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এজন্য ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের প্রত্যাহারের লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং দক্ষতাবৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় ২৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে তৈরি পোশাকশিল্প এবং চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে শতভাগ শিশুশ্রম মুক্ত করা হয়েছে। ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে শ্রম মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনে সম্প্রতি নতুন করে কর্মপরিকল্পানা প্রণয়ন করেছে। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী জাতীয় পর্যায় থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শিশুশ্রম নিরসনে কমিটি কাজ করছে।এদিকে শিশু বাজেটের অন্তর্ভুক্ত ১৫টি মন্ত্রণালয়ে এবার শিশুদের জন্য ৬৫ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা জাতীয় বাজেটের ১৪.১ শতাংশ (জিডিপির ২.৬ শতাংশ)। গত বছরের তুলনায় সরকারের সামাজিক সুরক্ষা বলয় কার্যক্রমে বরাদ্দ সমগ্র বাজেটের অংশ হিসেবে কমেছে। তবে শিশু সংশ্লিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে বরাদ্দ বেড়েছে ২০.২ শতাংশ। বিশেষ করে এ খাতে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ২৩০.৩ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা আইএলওর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে আট কোটি শিশু নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। শিশুশ্রম শিশুর উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে, শিশুর শৈশব কেড়ে নেয় এবং শিশুকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও শিশুশ্রম বলতে বুঝিয়েছে এমন শ্রম যা শিশুকে শৈশব থেকে বঞ্চিত করে তাদের সকল সম্ভাবনা ও মর্যাদা নষ্ট করে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যে বয়সে একজন শিশুর বই, খাতা, পেন্সিল নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া এবং আনন্দিতচিত্তে সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলা করার কথা, সেই বয়সেই শিশুকে নেমে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে অনেক মাতাপিতা ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেন না। স্বল্পশিক্ষিত মাতাপিতা দারিদ্র্যের কষাঘাতে যখন পরিবারের ভরণপোষণে ব্যর্থ হন তখন তারা সন্তানকে স্কুলে পাঠানো এবং লেখাপড়ার খরচ জোগাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তারা মনে করেন, সে যদি কাজে নিয়োজিত থাকে তাহলে সংসারের আয় সংকুলানে সহায়ক হয়। বাংলাদেশ সংবিধানে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে এবং জবরদস্তিমূলক শ্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমসহ সবধরনের শ্রমসাধ্য কাজ থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করে তাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলাই জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালার লক্ষ্য। এ নীতিমালায় শিশু বিকাশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো শিশু দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচঘণ্টার অতিরিক্ত সময় কাজ করে; নিরাপত্তাহীন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে; সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে; বিশ্রাম বা বিনোদনের কোনো সুযোগ না পায়; যা তার শিক্ষাজীবন ব্যাহত করে এবং এমন কোনো কাজে নিয়োজিত হয় যা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও অমর্যাদাকর তবে মালিক বা নিয়োগকর্তা শিশু অথবা তার অভিভাবকের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হবে। চুক্তি অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুকে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না।